বাড়ির পাশেই ছিল ডাকঘর, সেই ছোট্টকাল থেকে দেখা প্রান্তিক মানুষের সাথে চিঠির সখ্যতা, অপেক্ষা, আবেগ ও ভালোবাসা। মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে রবীন্দ্র, নজরুল, হালের হেলাল হাফিজ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সবাই সমৃদ্ধ করেছেন পত্র সাহিত্যকে। হারিয়ে যাওয়া অমূল্য সৃষ্টির এই মাধ্যমকে মনে রাখার ক্ষুদ্র প্রয়াস।
প্রিয় চারু,
আশা করি ভালো আছ, যান্ত্রিকতার এই সময়ে হঠাৎ পত্র পেয়ে
তুমি হয়তো অবাকই হয়েছ। কিন্তু আমার কাছে এখনও, পত্রই মনের ভাব প্রকাশের
শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। তুমি তো অবগত আছ, ২০০৭ সালে যখন দেশ থেকে বাহিরে আসলাম
নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবো প্রকৃত মানুষ রূপে। দু-চোখে আশার রঙিন স্বপ্ন আমার,
মতিভ্রম হলো ইউরোপের মাটিতে পা রেখে। ব্যস্তবতার সঙ্গে রঙিন স্বপ্নের যে
কোনো মিল নেই। সেদিন থেকেই বাঁচার লড়াই বা যান্ত্রিক পৃথিবীতে টিকে থাকার
লড়াই শুরু আমার।
আমরা যারা সুদূর এশিয়া থেকে আসি। প্রথমে যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হই, তার মধ্যে ভাষা, খাওয়া দাওয়া আর আবহাওয়া অন্যতম। সমস্যাগুলোর মধ্যে আমার কাছে যেটি প্রধান ও প্রকট মনে হয়েছে, তা হলো ভাষা। যদিও ইংলিশ সহায়ক হিসেবে কাজ করে। তারপরও ইউরোপের প্রতিটি দেশের ভাষা সংস্কৃতি ও ধর্ম আলাদা হওয়ায়, তার সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য সময়ের প্রয়োজন।
তুমি জেনে অবাক হবে এখানে ধর্মহীন মানুষের সংখ্যাও কম নয়, আমাদের মতো
লোক দেখানো বাহ্যিকতা ওদের নেই। সততা, নিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ আর মানবতা ওদের
মধ্যে বিদ্যমান। সময়ের প্রয়োজনে আমিও অভ্যস্ত হচ্ছিলাম, তার সাথে নিজেকে
স্থায়ীভাবে কোথাও প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাস্তা খুঁজছিলাম। ভালোই ছিলাম
মেডিটারেন পাড়ে প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার নিদর্শন ঘেরা ছোট্ট দ্বীপে।
২০১২
সালের দিকে জীবন ও জীবিকার তাগিদে, আমার নতুন আস্তানা ‘রোমিও জুলিয়েট’ এর
দেশ। ইতালিয়ানরা এত বেশি বই আর ফুল প্রেমী না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না,
মনে মনে ভাবি সাধে কি আর ‘রোমিও জুলিয়েট’ এখানে জন্মেছিলেন। এ তো প্রেমের
স্বর্গ রাজ্য! সাহিত্য, ফুল আর প্রেম একেই সুঁতায় বাঁধা।
ল্যাটিন থেকে আসা ভাষার মধ্যে ইতালিয়ান আমার কাছে সবচেয়ে শ্রুতিমধুর ও
গীতিময় ভাষা মনে হয়েছে। ভাষার প্রেমে পড়ে গেলাম, অল্প দিনে শিখেছিলাম রোমান
পরিবার থেকে আসা ডানেটে আলগেরি (ইতালিয়ান ভাষার জনক) ইর ভাষা। চলার পথে যে
কয়টি ভাষায় মানুষের সাথে কথোপকথন চালিয়ে যেতে পারি, তার মধ্যে ইতালিয়ানে
আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। সমসাময়িক অবস্থার প্রেক্ষিতে থাকা হলো না
ভিঞ্চির (লেনাড্রো ডা ভিনোচি) দেশে।
২০১৪ সালের দিকে, ভাসকো গামা
ডেকে নিলেন তার সাগর কন্যার দেশে! আকাশযানে যাওয়ার সময় ভুপেন বাবুর (ভূপেন
হাজারিকা) দুইটি লাইন বারবার মাথায় আসছিল,
‘আমি এক যাযাবর পৃথিবী আমারে আপন করেছে ভুলেছি
নিজের ঘর আমি গঙ্গার থেকে মিসিসিপি হয়ে ভলগার রূপ দেখেছি
অটোয়ার থেকে অস্ট্রিয়া হয়ে প্যারিসের ধুলো মেখেছি
আমি ইলোরার থেকে রং নিয়ে দূরে শিকাগো শহরে গিয়েছি
গালিবের ‘শের’ তাসখন্দের মিনারে বসে শুনেছি’
২০০৯ সালে শুরু হওয়া বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার রেশ তখনো কাটেনি। পর্তুগালের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও নাজুক। তখন কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না, নিজের জীবনযাপন তথা দেশের কথা চিন্তা করলে মাথা গুলিয়ে যেত। সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে দেশের প্রতি মায়া জন্ম নিলো। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জেনেও থেকে গেলাম লিসবনে, কি অদৃশ্য এক ভালো লাগায়।
আশা ছিল গ্লোবালাইজেশনের বেড়াজাল ছিন্ন করে পর্তুগাল একদিন জেগে উঠবে। লিসবনে থেকে যাওয়ার অন্যান্য কারণ হচ্ছে, অনুকূল আবহাওয়া ও পর্তুগিজদের বন্ধুসুলভ আচার আচরণ। আমার দেখা ইউরোপের অন্যান্য জাতির থেকে পর্তুগিজরা সহজ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। পর্তুগিজরা জাতিগতভাবে অভিযানিক ও দুঃসাহসিক হলেও বর্তমান প্রজন্ম কর্মবিমুখ ও স্বপ্নহীন মনে হয়েছে আমার কাছে।
বাস্তবতার সাথে মিল নাও থাকতে পারে, ইহা আমার ব্যক্তিগত ধারণা মাত্র। সময়ের বিবর্তনে আমার ও অবস্থার উন্নতি হয়েছে। পর্তুগালের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। মানুষের জীবনযাত্রায় মান উন্নত হয়েছে। আমি মন থেকে চাই পর্তুগাল দিনে দিনে উন্নতি করুক সার্বিক ভাবে। সব মানুষ সুখে থাকুক, এ যে আমার দ্বিতীয় বাড়ি!