ইরানের নবম প্রেসিডেন্ট হিসেবে মাসুদ পেজেশকিয়ান শনিবার জয়ী হয়েছেন। দ্বিতীয় রাউন্ডের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করা দুই চূড়ান্ত প্রার্থীর মধ্যে তিনি তুলনামূলকভাবে মধ্যপন্থী। ৫৩.৩ শতাংশ ভোট পেয়ে ৪৪.৩ শতাংশ ভোট পাওয়া অতি কট্টরপন্থী সাইদ জালিলির বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছেন তিনি। পেজেশকিয়ান নিজেকে স্বতন্ত্র দাবি করলেও গত ২৮ জুনের নির্বাচনে রিফর্ম ফ্রন্ট দলের সমর্থিত ছিলেন।
গত ১৯ মে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর পর ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
সরকার ঘোষিত পরিসংখ্যান অনুসারে, সংস্কারপন্থী প্রার্থী পেজেশকিয়ান প্রথম রাউন্ডের নির্বাচনের চেয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে ৭০ লাখের বেশি ভোট এবং তার অতি-কট্টর প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে প্রায় ৩০ লাখ ভোট বেশি পেয়েছেন। প্রথম রাউন্ডের নির্বাচনে প্রায় ৪০ শতাংশের মতো রেকর্ড সর্বনিম্ন ভোট পড়েছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, অ্যাক্টিভিস্ট ও হতাশ ইরানিরা ব্যাপকভাবে ভোট বয়কট করেছিল।
lতবে সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, শুক্রবার দ্বিতীয় রাউন্ডের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি প্রায় ১০ শতাংশ বেড়ে ৪৯.৮ শতাংশে পৌঁছয়। তবে বিরোধীদের অনেকেই এ পরিসংখ্যানকে চ্যালেঞ্জ করছে। দেশটির কঠোরভাবে সরকার নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় এই পরিসংখ্যানগুলো স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায় না।
এদিকে নতুন প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান তার প্রচারণার সময় অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
তবে অন্য প্রার্থীদের তুলনায় বিস্তারিত পরিকল্পনার অভাব ছিল। পেজেশকিয়ান পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে জেসিপিওএ পারমাণবিক চুক্তি পুনরুজ্জীবিত এবং ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি থেকে প্রত্যাহারের পর থেকে ইরানের অর্থনীতিকে অচল করে দেওয়া নিষেধাজ্ঞাগুলো প্রত্যাহার করার পক্ষে কথা বলেন। এমন পদক্ষেপের জন্য দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির অনুমোদন প্রয়োজন। পেজেশকিয়ানও এ বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা দেননি।
ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট আরো জোর দিয়েছিলেন, ইরানকে অর্থ পাচারবিরোধী ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ) নির্ধারিত আন্তর্জাতিক কনভেনশনগুলোতে প্রবেশ করতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং সম্পর্ক গড়ে ওঠে।ইরান ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এফএটিএফের কালো তালিকায় রয়েছে।
এ ছাড়া পেজেশকিয়ানের প্রচারণার পক্ষে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অবিরাম প্রচারণা চালানো সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ-জাভাদ জারিফ সম্ভবত তার মন্ত্রিসভায় ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হবেন। অন্যদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদটি জারিফের সাবেক ডেপুটি ও পারমাণবিক আলোচনাকারী আব্বাস আরাগচির জন্য সংরক্ষিত বলে জানা গেছে।
পেজেশকিয়ান প্রচারণার বিতর্কের সময় বলেছিলেন, তিনি নির্বাচনে জয়ী হলে নিম্ন আয়ের ও ঝুঁকিপূর্ণ ইরানিদের কর দিতে হবে না। তাদের জন্য বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। হাসান রুহানির (২০১৩-২০১৭) সরকারের অর্থনীতির সাবেক মন্ত্রী আলি তায়েবনিয়া পেজেশকিয়ানের অর্থনৈতিক দলের নেতৃত্বে থাকবেন বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। তায়েবনিয়া মুক্ত বাজার অর্থনীতির সমর্থক বলে বিশ্বাস করা হয়। কারণ ইরান সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানার কারণে দুর্ভোগে পড়েছে।
৭০ বছর বয়সী হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, আইন প্রণেতা ও সংসদের ফার্স্ট ডেপুটি স্পিকার (২০১৬-২০২০) এবং ইরান-ইরাক যুদ্ধের (১৯৮০-৮৮) অভিজ্ঞ মাসুদ পেজেশকিয়ান বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের শুরুর বছরগুলোতে নারীদের ওপর হিজাব চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করার কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু তিনি এখন দেশটির নীতি পুলিশের মাধ্যমে ইসলামী পোশাক কোডের সহিংস প্রয়োগ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পেজেশকিয়ান ২০০৯ সালে বিক্ষোভকারীদের ওপর সরকারের রক্তক্ষয়ী দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সংসদে তার আগ্রাসী বক্তৃতার জন্য পরিচিত।
মাহসা আমিনির মৃত্যুর এক দিন পর একটি টুইটে পেজেশকিয়ান তার বিরুদ্ধে সহিংসতার তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘একটি মেয়েকে তার হিজাবের জন্য গ্রেপ্তার করা এবং তার লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা’ ইসলামিক প্রজাতন্ত্রে অগ্রহণযোগ্য ও লজ্জাজনক। তিনি পরে বলেছিলেন, আমিনিকে হত্যার প্রতিবাদের কারণে ইরানের গার্ডিয়ান কাউন্সিল তাকে ২০২৪ সালের মার্চের সংসদ নির্বাচনে দাঁড়াতে বাধা দিয়েছে।
তিনি গ্রিন মুভমেন্টের নেতাদের গৃহবন্দি করার সমালোচনাও করেছেন, যাদের ২০১১ সাল থেকে তাদের বাসভবনে আটক রাখা হয়েছে।
পেজেশকিয়ান ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সংস্কারপন্থী মোহাম্মদ খাতামির অধীনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। খাতামি মার্চের সংসদীয় নির্বাচনে অকট্টরপন্থীদের ব্যাপকভাবে অযোগ্য ঘোষণার প্রতিবাদে ভোটদানে বিরত ছিলেন। তবে এবার তিনি পেজেশকিয়ানকে সমর্থন করেছিলেন ও তাকে ভোট দিয়েছিলেন। পেজেশকিয়ানের অতিরিক্ত ভোটগুলো সম্ভবত প্রথম রাউন্ড বয়কটকারীদের কিছু অংশ এবং প্রথম রাউন্ডে হেরে যাওয়া সংসদের স্পিকার মোহাম্মদ-বাঘের গালিবাফের সমর্থকদের কাছ থেকে এসেছে।
কট্টরপন্থী নির্বাচন পর্যবেক্ষক গার্ডিয়ান কাউন্সিলের কাছ থেকে পেজেশকিয়ানের অনুমোদন একটি চমক ছিল। তিনি ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট পদে নিবন্ধিত হলেও পরে তা প্রত্যাহার করেছিলেন এবং ২০২০ সালে আবার নিবন্ধিত হন, শুধু গার্ডিয়ান কাউন্সিলের কাছে অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার জন্য।