সারি সারি কলা, মাল্টা, কমলা, আনার গাছ আর মাচাং ভর্তি লাউ, মিষ্টি কুমড়া, করলা ও শিম গাছ দেখে যে কারোর পুরোদস্তুর একজন কৃষকের ঘর মনে হতে পারে। কিন্তু এটি যার ঘর তিনি মোটেও একজন কৃষক নন। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারকৃত আব্দুল সালামের ঘর এটি। আব্দুল সালাম ফুলবাড়ি উপজেলার খয়েরবাড়ি গ্রামের উত্তরপাড়ার বাসিন্দা। পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি ছিলেন তিনি। গ্রামে আড়াই শতাংশ জমির উপর নিজের একটি বাড়ি থাকলেও সরল বিশ্বাসে ছেলের নামে লিখে দেয়ার পর থেকেই নানান ভাবে অবহেলিত হতে থাকেন তিনি। এরই মধ্যে ডায়বেটিকসহ লিভারের সমস্যা ধরা পড়ে তার। ছেলের অবহেলার কারণে ভাড়া বাসায় গিয়ে উঠার মত সক্ষমতাও নেই তার। চারদিক যেন অন্ধকার হয়ে আসতে শুরু করল আব্দুল সালামের। হঠাৎ তিনি প্রধানমন্ত্রীর ঘর উপহার দেয়ার খবর শুনতে পান। আবেদন করার পর ঘর ও পেয়ে যান তিনি। ঘর নয় যেন নতুন করে বাঁচার রসদ খুঁজে পেলেন তিনি। হতাশা আর অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনে আলোর প্রদীপ জ্বলতে শুরু করল।
রংপুর বিভাগের সর্ববৃহৎ আবাসন প্রকল্প দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার খয়েরবাড়ী ইউনিয়নের বালুপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, শাখা যমুনা নদীর তীরঘেষে একই জায়গায় প্রধান মন্ত্রীর উপহারের ২৫৩টি বাড়ী নির্মান করে একটি নতুন আদর্শ্য গ্রাম স্থাপন করা হয়েছে। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগও দেয়া হয়েছে। এই গ্রামের মাঝে রয়েছে একটি খেলার মাঠ, গ্রামের পাশ দিয়ে এখনো অনেক ফাঁকা জায়গাও পড়ে রয়েছে, সেই জায়গায় আবাসনের বাসীন্দারা গড়ে তুলেছে মৌসুমী সবজির বাগান। এছাড়া বাড়ীর সাথে ঘর করে শুরু করেছেন গবাদিপশু পালনও।
তৃপ্তি আর আনন্দ মাখা মুখে আব্দুল সালাম বলেন, ‘এই ঘর পাওয়ার আগে যে হতাশা আর দু:খ-কষ্টে ছিলাম তা অনেকটাই দূর হয়েছে। এখন যদি একবেলা ডাল ভাত খেয়ে থাকি তবু শান্তিতে এই ঘরে ঘুমাতে পারি। আমি একজন কাঠমিস্ত্রি। ডায়বেটিক আর লিভারের সমস্যার কারণে এখন তো আর কাজ করতে পারিনা। তাই এই ঘরে আসার পর থেকে অবসর সময়টা কাটনোর জন্য বিভিন্ন রকম গাছ লাগাতে শুরু করি। পাশরে জমি থেকে মাটি তুলে ঘরের চারপাশটা ভরাট করি। তারপর কলা, মাল্টা, কমলা আনারসহ বিভিন্ন ফলের গাছ লাগাই। আর লাউ, কুমড়া, শিম গাছের জন্য মাচাংয়ের ব্যবস্থা করলাম। এখন মাচাং ভর্তি লাউ-কুমড়া ধরতেছে। নিজে এগুলো খাচ্ছি আর প্রতিবেশীদেরকেও দিচ্ছি। আশা করছি লাউ, শিম আর মিষ্টি কুমড়া কিছুদনি পর বিক্রি করে কিছ টাকা আয় করতেও পারব। আসলে ঘর নয়, আমি যেন নতুন করে বাঁচার পথ খুঁজে পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদেরকে এই ঘর যে দান করল, আমার কাছে মনে হয় এটাই পৃথবিীর সবচেয়ে বর দান। এর চেয়ে বড় দান আর পৃথিবীতে হয় না।
সালামের স্ত্রী রাশেদা বেগম বলেন, ঘর পাবার পর থেকে এখন আমরা ভালই আছি। আমি প্রধানমন্ত্রীর জন্য প্রতিদিন দোআ করি আল্লাহ যেন তাকে সুস্থ রাখেন, অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখেন। এখন বেঁচে থাকার জন্য এই ঘরটাই আমাদের সম্বল। আমি আর আমার স্বামী মিলে ঘরের পাশে বিভিন্ন রকম গাছ লাগাইছি। আমাদের গাছ লাগানো দেখে এখন প্রতিবেশীরাও গাছ লাগাচ্ছে। আমরাও তাদের গাছ লাগাতে সাহায্য করতেছি।
আব্দুল সালামের প্রতিবেশি কল্পনা বেগম বলেন, সালাম ভাইয়ের গাছগুলো দেখে আমি তো বেশ অবাক হয়ে গেছি। এত অল্প সময় আর অল্প জায়গার মধ্যে এত সুন্দর একটা বাগান করছে। আমিও আমার ঘরের পাশে গাছ লাগাব। পাশের জমি থেকে মাটি তুলে ভরাট করতেছি। কয়েকদিনের মধ্যে গাছ লাগাতে পারব। নিজে খাওয়ার মত একটু শাক-সবজি হলে অনেকটা খরচ বেঁচে যাবে।
ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় এই উপজেলায় ৯৬৯টি ঘর বরাদ্দ করা হয়। এর মধ্যে প্রথমদফায় ৭৬৯টি ও দ্বিতীয় দফায় ২০০টি বাড়ী। প্রথমদফায় এলুয়াড়ী ইউনিয়নে ১০৫টি, আলাদিপুর ইউনিয়নে ১১৬টি, কাজিহাল ইউনিয়নে ১০১টি, বেতদিঘী ইউনিয়নে ১০৪টি, খয়েরবাড়ী ইউনিয়নে ২৫২টি, দৌলতপুর ইউনিয়নে ৫৬টি, শিবনগর ইউনিয়নে ৩৫টি বাড়ী নির্মান করা হয়। এছাড়া দ্বিতীয় দফায় এলুয়াড়ী ইউনিয়নে ৩৫টি, আলাদিপুর ইউনিয়নে ৩০টি, কাজিহাল ইউনিয়নে ৩০টি, বেতদিঘী ইউনিয়নে ৩০টি, খয়েরবাড়ী ইউনিয়নে ২৫টি, দৌলতপুর ইউনিয়নে ৫০টি বাড়ী নির্মান করা হয়। নির্মিত এসব বাড়ীর মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ জন রয়েছেন ভুমিহীন ভিক্ষুক। এছাড়া এসব বাড়ী পেয়েছেন প্রতিবন্ধী, সমাজের অসহায়, ভুমিহীনরা।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার রিয়াজ উদ্দিন বলেন, আবাসনের বাসীন্দাদের স্বাবলম্বি করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তার মধ্যে অনেককে সেলাই প্রশিক্ষন দেয়া হয়েছে। যাতে তারা প্রধানমন্ত্রীর ঘরে স্বাবলম্বি ও আত্মনির্ভশীল হতে পারে। এছাড়াও ঘর পাওয়াদের স্বাবলম্বী হতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ঘর পাওয়া উপকারভোগীরা নিজেদের বাড়ীর পাশে বিভিন্ন শাক-সবজি ও ফলমুল চাষ করে পরিবারের পুষ্টির ব্যবস্থা করছেন।
গত ৩১ জুলাই ফুলবাড়ী উপজেলার আলাদিপুর ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পরিদর্শন করেন জেলা মনিটরিং কমিটি। পরিদর্শনে নেতৃত্ব দেন জেলা মনিটরিং কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক খালেদ মোহাম্মদ জাকী। এসময় কমিটির সদস্য ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আজিজুল ইমাম চৌধুরী, সদস্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মুরাদ হোসেন, সদস্য সচিব অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) শরিফুল ইসলাম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিয়াজ হোসেন, উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মিল্টন প্রমুখ।
পরিদর্শনকালে কমিটির সদস্যরা উপকারভোগীদের সাথে কথা বলেন। এসময় উপকারভোগীরা বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরলে শিঘ্রই সমস্যাগুলো সমাধানের আশ্বাস দেন কমিটির সদস্যরা। এসময় জেলা প্রশাসক খালেদ মোহাম্মদ জাকী বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভুমিহীনদের জন্য এই ঘর নির্মান করেছেন। এই ঘর নির্মানে কোন ধরনের অনিয়ম সহ্য করা হবে না। এছাড়াও প্রকৃত ভুমিহীনরা যেন এই ঘর বরাদ্দ পান সে ব্যাপারে জেলা মনিটরিং কমিটি কাজ করছে। উপকারভোগীদের সাথে আমরা কথা বলেছি। যাদের অভিজ্ঞতার উপর বিবেচনা করে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবো আমরা। এছাড়াও আগামীতে আমাদের মনিটরিংয়ের কার্যক্রম চলমান থাকতে।