অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রাশা (ছদ্মনাম)। স্কুলে যাওয়া- আসার পথে তাকে কিছু বখাটের মুখোমুখি হতে হয় রোজ। কোনো মতে সে বাসা পর্যন্ত রোজ আসে। কিন্তু শিশুর মন মনে করে, বিষয়টি বাসায় জানলে হয়তো তার স্কুল যাওয়া বন্ধ হবে, হয়তো তার দোষ দেখবে সবাই।
একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে পাশের দেয়ালে দেখা যায়- কেউ তার নাম লিখে কিছু ‘অস্বস্তিকর’ ছবি এঁকে রেখেছে। এতদিন ধরে একা যে যন্ত্রনা সহ্য করে আসছিল রাশা, মুহূর্তে সারা পাড়ায় সেটা জানাজানি হয়ে যায়। দীর্ঘদিনের এই হয়রানির বিষয়টি বাসায় না জানানোর জন্য শুনতে হয় কটূকথা। ছোট্ট রাশার মনে হয়, এই জীবন রাখার মানে হয় না। সে আত্মহত্যার চেষ্টা করে, তবে বেঁচে যায়।
বেসরকারি সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের ‘শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ক্রমবর্ধমান: কোন পথে সমাধান?’ শীর্ষক সমীক্ষার ফলাফল বলছে, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা। সমীক্ষায় যাদের পরিসংখ্যান নেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের ৪৬ দশমিক ৮ শতাংশই ছিল স্কুলগামী। এদের মাঝে নারী শিক্ষার্থী ছিল ১১২ জন এবং পুরুষ শিক্ষার্থী ৫৭ জন। এছাড়া আত্মহত্যাকারীদের মাঝে কলেজগামী শিক্ষার্থী ২৬ দশমিক ৬০ শতাংশ।
আত্মহত্যার ঘটনা অনুসন্ধানে আঁচল ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ বলছে, যে কারণগুলো সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সেগুলো হলো- অভিমান, প্রেমঘটিত সমস্যা, সেশনজট, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, পড়াশোনার চাপ, পরিবার থেকে কিছু চেয়ে না পাওয়া, পারিবারিক কলহ, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি, চুরি বা মিথ্যা অপবাদ, মানসিক সমস্যা, বিয়েতে প্রত্যাখ্যাত, স্বামী পছন্দ না হওয়া, বাসা থেকে মোটরবাইক কিনে না দেয়া ইত্যাদি। আরও রয়েছে, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, বিষন্নতা, বন্ধুর মৃত্যু, আর্থিক সমস্যার মতো বিষয়াবলিও। প্রাপ্ত উপাত্ত অনুসারে, সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ২৫ দশমিক ২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেছেন, বিভিন্ন কারণে অভিমান করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন ২৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ শিক্ষার্থী।
রাজধানীর একটি রিহ্যাব সেন্টারে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেন এমন একজন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, ১৫ থেকে ২১ বয়সী অনেক মেয়ে আমাদের কাছে আসে। তাদের কেউ কেউ মাদকাসক্ত। আমরা কথা বলতে গিয়ে দেখি- তারা কী ভীষণ মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গেছে এই বয়সেই। ভাবতে গা শিউরে উঠবে। অনেকের বাবা-মা হয়তো খেয়ালই করেনি, তার সন্তানের ওপর দিয়ে কী যাচ্ছে।
আবার এমনও আছে, বাবা মা এতই দায়িত্বশীল এবং এত যত্নশীল যে, সন্তানের জন্য তা চাপের বিষয় হয়ে যায়। করণীয় কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, বয়ঃসন্ধিকালের শিশুদের ক্ষেত্রে বাবা-মাকে আরেকটু সহনশীল হতে হবে। একেকজন সন্তান একেক রকম। সবাইকে এক পাল্লায় না মেপে কে কেমন ভালোবাসে, সেটা বুঝতে হবে। আর স্কুলের শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যাপারে কড়াকড়ি আনা দরকার। তারা সংবেদনশীল না হলে তাদের প্রমোশন হবে না, চাকরি যাবে এমন নিয়মও থাকা দরকার।
এত সংখ্যক স্কুলগামী মেয়েদের আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহমদ বলেন, পর্যবেক্ষণে এসেছে অভিমানের কারণে অনেকে আত্মহত্যা করে। সবাই যে একই মানদণ্ডে ভাবেন, তা নয়। একজন প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করেন মানে, সবাই করবে এমন না। মানে প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্নভাবে নিজেকে তৈরি করে। আমরা বারবার বলছি, শরীরের পাশাপাশি মনের চিকিৎসাও জরুরি। মনের চিকিৎসা মানে পাগল না। কেবল কথা বলার জন্যও সাইকোলজিস্টের কাছে, থেরাপিস্টের কাছে যেতে পারেন। তারা যখন নিজেদের কথা বলার জায়গা পায় না, তখন তারা এই চেনা জগত ছেড়ে চলে যেতে চায়।