পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। পর্যটন শহর হওয়ায় পর্যটকের ভিড় থাকে সারা বছরই। এ শহরে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। কিন্তু দেশের অন্যতম বৃহত্তম এ সড়কটি সরু দুই লেনের। সঙ্গে যোগ হয় সড়কের ওপর থাকা বাজারের ব্যস্ততা। ফলে প্রতিনিয়তই লেগে থাকে যানজট। নষ্ট হয় সময়, অর্থ ও জ্বালানি। কিন্তু এবার এসব সমস্যা, দুর্ভোগ ও ভোগান্তি দূর হচ্ছে। স্বপ্নের রেল যাবে কক্সবাজারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শনিবার এ রেলপথের উদ্বোধন করবেন
আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজীকরণে পর্যটন নগরীর সঙ্গে রাজধানীসহ সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের দাবি বহুদিনের। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার পাশাপাশি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের দাবি দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন সম্প্রসারণ প্রকল্প হাতে নেয়।
গুরুত্ব বিবেচনায় ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। কক্সবাজার পর্যটন শহরও। পর্যটকের ভিড় থাকে সারা বছরই। এ শহরে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। কিন্তু দেশের অন্যতম বৃহত্তম এ সড়কটি সরু দুই লেনের। সঙ্গে যোগ হয় সড়কের ওপর থাকা বাজারের ব্যস্ততা। ফলে প্রতিনিয়তই লেগে থাকে যানজট। দুর্ভোগে পড়তে হয় যাত্রীদের। ৫ ঘণ্টার যাত্রায় লেগে যায় ৭ ঘণ্টা। নষ্ট হয় সময়, অর্থ ও জ্বালানি। দেশের একপ্রান্ত পঞ্চগড় থেকে অন্যপ্রান্তে কক্সবাজারে রেললাইন চালু হয়েছে। এটিও সরকারের অন্যতম একটা সাফল্য বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
কিন্তু এবার এসব সমস্যা, দুর্ভোগ ও ভোগান্তি দূর হচ্ছে। বহুল কাঙ্ক্ষিত ও প্রতীক্ষিত রেললাইন চালু হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার। স্বপ্নের রেল যাবে কক্সবাজারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে রেললাইনের উদ্বোধন করবেন। এর আগে প্রথমবারের মতো গত ৪ নভেম্বর ইঞ্জিন রেল এবং ৫ নভেম্বর ইঞ্জিন, বগিসহ আটটি কোচ নিয়ে কক্সবাজার যায় রেলওয়ে পরিদর্শন অধিদপ্তরের একটি বিশেষজ্ঞ দল।
এর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে তৈরি হলো রেল যোগাযোগ। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত করতে পারবেন রেলপথে। দেশের ৪৫তম জেলায় যুক্ত হবে রেল। রাজধানী ঢাকার সঙ্গেও যুক্ত হলো সরাসরি রেল যোগাযোগ। দেশের পর্যটন খাত এগিয়ে যাবে আরেক ধাপ। দৈনিক যাতায়াত করতে পারবে প্রায় ১ লাখ মানুষ। কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা ইউনিয়নের চান্দের পাড়ায় নির্মিত হয়েছে দেশের প্রথম ঝিনুক আকৃতির আইকনিক স্টেশন।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ সুবক্তগীন বলেন, কক্সবাজার রেললাইন যাত্রা যোগাযোগে এটি একটি মাইলফলক উদ্যোগ, সরকারের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এ রেলের মাধ্যমে ঢাকা থেকে ৭ ঘণ্টা ও চট্টগ্রাম থেকে ২ ঘণ্টায় কক্সবাজার যাওয়া যাবে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য যোগাযোগে তৈরি হবে অবারিত সুযোগ। তৈরি হলো পর্যটক ও স্থানীয় জনগণের জন্য নিরাপদ, আরামদায়ক ও সাশ্রয়ী যোগাযোগ ব্যবস্থা।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার নাজমুল ইসলাম বলেন, ইঞ্জিন ট্রায়াল, আটটি কোচ নিয়ে রেলওয়ে পরিদর্শন পরিদপ্তর দলের পরিদর্শন শেষে আজ ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী রেললাইনটি উদ্বোধন করছেন। এর মাধ্যমে দেশের ৪৫তম জেলায় রেল যুক্ত হল। দেশের রেলের ইতিহাসে এটি এক নতুন মাত্রা যোগ করল। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর আগামী ২০ বা ২৫ নভেম্বর থেকে বাণিজ্যিকভাবে রেল চলাচল শুরু হবে।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনটি ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পটি ২০১০ সালের ৬ জুলাই একনেকে অনুমোদন পায়। পরে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার এবং রামু-ঘুমধুম পর্যন্ত মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়। প্রকল্পের অধীনে কক্সবাজারে নির্মিত হয়েছে ঝিনুকের আদলে দেশের প্রথম অত্যাধুনিক আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন। প্রকল্পে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। রেলপথটি নির্মিত হলে মিয়ানমার, চীনসহ ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের করিডোরে যুক্ত হবে বাংলাদেশ।
জানা যায়, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার। দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার। বর্তমানে দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন আছে। এ কারণে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে বন, পাহাড় ও নদী পাড়ি দিয়ে রেলপথটি যাচ্ছে কক্সবাজারে। দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজরা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজারে হয়েছে ৯টি স্টেশন। এসব স্টেশনে থাকবে কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলক সিগন্যাল সিস্টেম এবং ডিজিটাল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম। সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মাণ হচ্ছে তিনটি বড় সেতু। এ ছাড়া পুরো রেলপথে নির্মিত হচ্ছে ৪৩টি ছোট সেতু, ২০১টি কালভার্ট এবং ১৪৪টি লেভেল ক্রসিং।
নির্মিত রেললাইন দিয়ে সহজ ও কম খরচে মাছ, লবণ, কাগজের কাঁচামাল, বনজ এবং কৃষিজ দ্রব্যাদি পরিবহন করা যাবে। এ ছাড়া মাছ, লবণ, শুঁটকিসহ নানা পণ্য কক্সবাজার থেকে দেশের অন্যান্য স্থানে পরিবহনের জন্য থাকবে বিশেষ রেফ্রিজারেটেড ওয়াগন সার্ভিস। একই সঙ্গে প্রকল্প নির্মাণে হাতি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর নির্বিঘ্নে চলাচলের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। এ রেলপথে হাতি চলাচলে একটি ৫০ মিটার দীর্ঘ ওভারপাস ও তিনটি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হয়েছে। কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা ইউনিয়নের চান্দের পাড়ায় নির্মিত হয়েছে দেশের প্রথম ঝিনুক আকৃতির আইকনিক স্টেশন। আধুনিক এ স্টেশনে যাত্রীদের জন্য আছে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। আছে থাকার ব্যবস্থা, ওয়েটিং রুম, এক্সক্যাভেটরসহ আনুষঙ্গিক সুবিধা।
দেশের প্রথম ঝিনুক আকৃতি আইকনিক স্টেশন: দোহাজারী কক্সবাজার রেললাইনের মূল স্টেশনটি কক্সবাজারে। এটি দেখতে ঝিনুক আকৃতির মতোই। কক্সবাজারের সৈকত থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে ঝিলংঝা ইউনিয়নের চান্দের পাড়ায় ২৯ একর জমির ওপর ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩৭ বর্গফুটের। ভবনটি হবে ছয়তলা। প্রথম দেখায় বোঝার উপায় নেই এটি কি। দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পে সবচেয়ে বড় আধুনিক আইকনিক ঝিনুকের আদলে তৈরি হওয়া ছয়তলা এ স্টেশন। এ স্টেশনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সৌন্দর্য।
পর্যটকরা লাগেজ স্টেশনে রেখে সারা দিন সমুদ্রসৈকত এবং দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে রাতের ট্রেনে আবার ফিরতে পারবেন নিজ গন্তব্যে। এ ছাড়া ভবনটিতে থাকবে প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জ, শপিংমল, রেস্তোরাঁ, তারকামানের হোটেল-রেস্তোরাঁ ও কনফারেন্স হল। স্টেশনটির দ্বিতীয়তলার ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার করে যাত্রীরা উঠবেন ট্রেনে। ছয়তলা স্টেশন ভবনে যাত্রীদের ওয়েটিং রুম, লকার সুবিধা, শিশু যত্ন কেন্দ্র, খেলার জায়গা, মিলনায়তনসহ আধুনিক সব সুবিধা রয়েছে।