প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী সবসময় দেশ ও জণগণের পাশে আছে। যেকোন দুর্যোগে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী তাদের পাশে দাঁড়ায়, শুধু দেশে নয় বিদেশেও।’
আজ শনিবার (২ মার্চ) বেলা সাড়ে ১১টায় রাজশাহী সেনানিবাসে বাংলাদেশ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের তৃতীয় কোর পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যখনই বন্ধু প্রতীম কোন দেশে দুর্ঘটনা ঘটে তখনই আমাদের সশস্ত্র বাহিনী সেখানে যায় এবং উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণ ও সেবা দিয়ে থাকে। পাশাপাশি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী শান্তিরক্ষী বাহিনী গৌরবজনকভাবে দায়িত্ব পালন করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে যাচ্ছে। তিনি সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে সাম্প্রতিক তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্প ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের উদ্ধার কাজে সফলভাবে অংশগ্রহণের উল্লেখ করেন।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘তার সরকার সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলেছে যাতে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় এ বাহিনী সক্ষম হয় এবং এ লক্ষ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।’
সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়নে গৃহীত বিভিন্ন প্রকল্পের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তার সরকার সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিক ও যুগোপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। আমরা ক্ষমতায় আসার পর থেকে সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু পদাতিক ডিভিশন, ব্রিগেড, ইউনিট এবং প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট তৈরি করেছি।’
প্রথম মেয়াদে সরকারে থাকার সময় তাঁরা ১৯৯৮ সালে ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ’ এবং ‘মিলিটারি ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’, ১৯৯৯ সালে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিং’ এবং ‘আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রথম মহিলা সৈনিক ভর্তির যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘২০০৯ সালে পুনরায় সরকার গঠনের পর প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন যুগোপযোগী সামরিক বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করছি। আমরা ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর আধুনিকায়ন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন এবং ২০১৬ সালে ‘বাংলাদেশ পিস বিল্ডিং সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেছি। জাতির পিতা প্রণীত প্রতিরক্ষানীতিকে যুগোপযোগী করে ‘জাতীয় প্রতিরক্ষানীতি, ২০১৮’ প্রণয়ন করেছি। অ্যারোস্পেস ও এভিয়েশন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং সিএমএইচগুলোকে অত্যাধুনিক হাসপাতালে রূপান্তরিত করেছি।’
তিনি বলেন, ‘দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করতে তাঁর সরকার সিলেটে ১৭ পদাতিক ডিভিশন, রামুতে ১০ পদাতিক ডিভিশন এবং বরিশালে ৭ পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠা করেছে। গত ৪ বছরে বিভিন্ন ফরমেশনের অধীনে ৩টি ব্রিগেড এবং ছোট-বড় ৫৮টি ইউনিট প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সম্প্রতি মাওয়া-জাজিরাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শেখ রাসেল সেনানিবাস এবং মিঠামইন, রাজবাড়ী ও ত্রিশালে নতুন সেনানিবাস স্থাপনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে আর্মি এভিয়েশনের ফরোয়ার্ড বেস এবং লালমনিরহাটে এভিয়েশন স্কুল নির্মাণের কাজও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পাশাপাশি সেনাবাহিনীতে নতুন কম্পোজিট ব্রিগেড ও প্যারা কমান্ডো ব্রিগেড যুক্তকরণ এবং প্রতিটি বাহিনীর জন্য অত্যাধুনিক এবং যুগোপযোগী অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সৌম্য, শক্তি, ক্ষিপ্রতা- এ মূলমন্ত্রে দীক্ষিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবময় এবং ঐহিত্যপূর্ণ। দেশ মাতৃকার সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আমাদের এই রেজিমেন্টের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন কাজে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। সেজন্য সকলকে আমার আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।’
তিনি বলেন, ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তার হৃদয়ের খুব কাছের। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে শহীদ তার দুই ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল এবং লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল এই রেজিমেন্টের সদস্য ছিলেন। তাই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পুনর্মিলনীতে যোগ দেয়া একদিকে আমার জন্য বেদনাদায়ক, অন্যদিকে আনন্দের।’
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে রেজিমেন্টের একটি চৌকস দল রাষ্ট্রীয় সালাম জানায়। প্রধানমন্ত্রী সালাম গ্রহণ করেন এবং খোলা জীপে চড়ে কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন। এ সময় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ তাঁর সাথে ছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রী বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও প্রত্যক্ষ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের পর ধ্বংসস্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে জাতির পিতা এদেশকে গড়ে তুলেছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সে সময়ই তিনি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলেন এবং সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নের পদক্ষেপ নেন।’
সরকার প্রধান বলেন, ‘১৯৭৪ সালেই জাতির পিতা কুমিল্লা সেনানিবাসে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি’র শুভ উদ্বোধন করেন এবং কম্বাইন্ড আর্মস স্কুল ও সেনাবাহিনীর প্রতিটি কোরের জন্য স্বতন্ত্র ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর শাসনামলে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। তিনি ভারত ও যুগোশ্লাভিয়া থেকে নৌবাহিনীর জন্য যুদ্ধ জাহাজ সংগ্রহ করেন। ১৯৭৩ সালে সে সময়ের অত্যাধুনিক সুপারসনিক মিগ-২১ যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার, পরিবহন বিমান, এয়ার ডিফেন্স রাডার বিমান বাহিনীতে যুক্ত করেন। তিনি ১৯৭৪ সালেই একটি প্রতিরক্ষানীতি প্রণয়ন করেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৭৫ সালে আমাদের বিজয়ের ইতিহাস কলঙ্কলিপ্ত হয়। জাতির পিতাকে হত্যার পর সমস্ত উন্নয়ন অগ্রযাত্রা থেমে যায় এবং আমাদের স্বাধীনতার আদর্শ প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘জাতির পিতার ঐতিহাসিক ভাষণ, যে ভাষণ আড়াই হাজার বছরে মানুষকে উদ্বুদ্ধকরণের শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যে ঠাঁই পেয়েছে সে ভাষণ এবং জয়বাংলা শ্লোগানও এই দেশে নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৯৬ সালে একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে মানুষ আবার সেই সত্য ইতিহাস জানার সুযোগ পায়। পাশাপাশি তাঁর সরকার সশস্ত্র বাহিনীকে সুপ্রশিক্ষিত এবং শক্তিশালী ও আধুনিকায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করে।’
তিনি তাঁর গৃহহীণ ভূমিহীনকে ঘর করে দেয়ার আশ্রয়ন প্রকল্পসহ ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রণয়ন এবং দেশের অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজে সশস্ত্র বাহিনীর অংশগ্রহণেরও প্রশংসা করেন।
তিনি বলেন, ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতি দেশ ও জাতির আস্থার স্বীকৃতি স্বরূপ এ পর্যন্ত ৩৫টি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট জাতীয় পতাকা অর্জন করেছে, ২০১৪ সালে আমার হাতে এ প্যারেড গ্রাউন্ডে ৩টি রেজিমেন্টের জাতীয় পতাকা গ্রহণের স্মৃতি আজ মনে পড়ছে।
প্রধানমন্ত্রী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদেরকেও ধন্যবাদ জানান। তাদের সময়ে তারাও এই বাহিনীকে উন্নত করতে যথাযত পরিশ্রম করেছেন। নিশ্চই আপনাদের সেই অভিজ্ঞতা আজকের প্রজন্ম স্মরণ করবে এবং যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আনন্দ ও উৎসবমুখর পুনর্মিলনী অবসরপ্রাপ্ত ও চাকুরিরত সর্বস্তরের সদস্যদের মাঝে সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ আরও সুদৃঢ় করবে এই প্রত্যাশা করছি। আমাদের দেশ প্রেমিক ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যগণ জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ অর্পিত সকল দায়িত্ব সফলতার সাথে পালনে সক্ষম হবে এবং কর্মজীবনে সকল ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে বলেই আমি বিশ্বাস করি।’
তিনি আজকের অনুষ্ঠান সফলভাবে আয়োজন করায় সেনাবাহিনী প্রধানসহ সংশ্লিষ্ট সকলকেও ধন্যবাদ জানান।