Friday , May 17 2024
Breaking News

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নারী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে?’ বিষয়ের ওপর ২০০৪ সালে একটি শ্রোতা জরিপের আয়োজন করে বিবিসি বাংলা। সেই জরিপে শ্রোতাদের ভোটে শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় ষষ্ঠতম স্থানে আসেন নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।

আজ বৃহস্পতিবার তার জীবন-কথা নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা।

প্রতিবেদনটি পাঠকদের জন্য তুলে দেয়া হলো-

বাঙালির আধুনিক যুগের ইতিহাসে যে নারীর নাম গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়, সেই নাম হচ্ছে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন– বেগম রোকেয়া।

বাঙালি সমাজ যখন সামাজিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল, সেই সময় বেগম রোকেয়া বাংলার মুসলিম নারী সমাজে শিক্ষার আলো নিয়ে এসেছিলেন। বাঙালি মুসলমান নারী জাগরণের তিনি ছিলেন অন্যতম একজন পথিকৃৎ।

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্ম ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে এক অভিজাত পরিবারে।

মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে তার পরিবার ছিল খুবই রক্ষণশীল। সেই সময় তাদের পরিবারে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর কোনো চল ছিল না।

আর তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় ঘরের বাইরে গিয়ে মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভেরও কোনো সুযোগ ছিল না।

তাই প্রথম জীবনে গোপনে দাদার কাছে একটু আধটু উর্দু ও বাংলা পড়তে শেখেন বেগম রোকেয়া।

তার বড় দুভাই কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে শিক্ষালাভ করেছিলেন। তার বড় বোন করিমুন্নেসাও ছিলেন বিদ্যোৎসাহী।

শিক্ষালাভ ও মূল্যবোধ গঠনে বড় দুভাই ও বোন রোকেয়ার জীবনকে প্রভাবিত করলেও তার আসল লেখাপড়া শুরু হয়েছিল বিয়ের পর স্বামীর সাহচর্যে।

শিশু বয়সে মায়ের সঙ্গে কলকাতায় বসবাসের সময় তিনি লেখাপড়ার যে সামান্য সুযোগ পেয়েছিলেন, তা সমাজ ও আত্মীয়স্বজনের সমালোচনায় বেশিদূর এগোতে পারেননি, যদিও ভাইবোনদের সমর্থন ও সহযোগিতায় তিনি অল্প বয়সেই আরবি, ফার্সি, উর্দু ও বাংলা আয়ত্ত করেছিলেন।

বিহারের ভাগোলপুরে স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিয়ের পর তার জীবনে নতুন এক অধ্যায়ের শুরু হয়েছিল। কলকাতায় অধ্যাপিকা, গবেষক ও রোকেয়া সাহিত্য সমগ্রের সম্পাদক ড. মীরাতুন নাহার বলেন, বেগম রোকেয়া খুব সুন্দরী ছিলেন এবং তার বিয়ে হয়েছিল খুব কম বয়সে।

ড. মীরাতুন নাহার বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘রোকেয়ার স্বামী ছিলেন খুব উদার মনের মানুষ এবং শিক্ষিত ব্যক্তি। বেগম রোকেয়া কিছুটা উর্দু তো আগেই শিখেছিলেন। বিয়ের পর সেই শিক্ষা তার উর্দুভাষী স্বামীর সহায়তায় আরও প্রসার লাভ করল। স্বামীর কাছ থেকে ইংরেজিতে খুব ভালো দক্ষতা অর্জন করলেন। সুন্দর ইংরেজি রচনা করতে পারতেন তিনি। তবে বাংলা ভাষার প্রতি তার ছিল গভীর টান। বাংলা তিনি ছাড়লেন না। বাংলাতেই তিনি লেখালেখি শুরু করলেন।’

বেগম রোকেয়ার সাহিত্যচর্চার সূত্রপাতও হয়েছিল স্বামীর অনুপ্রেরণায়। তার সাহিত্যজীবন শুরু হয় ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ নামে একটি বাংলা গদ্য রচনার মধ্য দিয়ে। তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে ছিল প্রবন্ধ সংকলন ‘মতিচুর’ এবং বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ‘সুলতানার স্বপ্ন’।

তার ‘সুলতানার স্বপ্নকে’ বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসাবে ধরা হয়।

১৯০৯ সালের ১৩ মে স্বামীর মৃত্যুর পর আত্মপ্রকাশ করলেন এক নতুন বেগম রোকেয়া। লেখালেখির বাইরে সমাজে বদল আনার দিকে এবং নারী শিক্ষার বিস্তারেও তিনি মন দিলেন।

বেগম রোকেয়াকে নিয়ে প্রথম তথ্যচিত্র নির্মাতা বাণী দত্ত বিবিসি বাংলাকে জানান কীভাবে কুসংস্কারের বেড়াজাল ডিঙিয়ে তিনি নারীদের শিক্ষাদানে ব্রতী হয়েছিলেন।

রোকেয়া বিষয়ে বাণী দত্ত বলেন, ‘মেয়েদের অভিভাবকরা যাতে তাদের স্কুলে পাঠায় তার জন্য তিনি নিজে পর্দা করে, বোরকা পরে মেয়েদের বাড়ি বাড়ি যেতেন। সব সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে তার স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি আজ কলকাতার একটি নামকরা মেয়েদের সরকারি স্কুল– সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গালর্স হাইস্কুল।’

সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গালর্স হাইস্কুল কয়েকবার স্থান বদল করে এখন কলকাতার লর্ড সিনহা রোডে প্রথম সারির সরকারি মেয়েদের স্কুল।

স্কুলটি তিনি প্রথম শুরু করেন ভাগোলপুরে ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর। তার পর পারিবারিক কারণে বেগম রোকেয়া ভাগোলপুর ছেড়ে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন এবং ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ কলকাতার ১৩নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের একটি বাড়িতে নতুন পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’।

আট ছাত্রীকে নিয়ে শুরু হয়েছিল কলকাতায় সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের যাত্রা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক সোনিয়া আনিম বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ‘তিনি মনে করেন নারী হিসেবে মেয়েরা আজ যেখানে পৌঁছেছেন, তারা সেখানে পৌঁছতেন না, যদি নারীর উন্নতির জন্য বেগম রোকেয়ার মতো মনীষীর অবদান না থাকত।’

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম বলেন, ‘ধর্ম ও সমাজের অনেক রীতিনীতি বেগম রোকেয়া মেনে নিয়েছিলেন ঠিকই; কিন্তু একটি রক্ষণশীল পরিবারে বড় হয়ে ওঠার পরও তিনি সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থাগুলোকে উপেক্ষা করে এগোতে পেরেছিলেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘রোকেয়ার সব কিছুর মাঝে যে একটি প্রচণ্ড ধরনের বিদ্রোহ ছিল– প্রচলিত সমাজব্যবস্থা, নারীর প্রচলিত অবস্থান, নারীর প্রতি তৎকালীন সমাজের প্রচলিত যে দৃষ্টিভঙ্গি–এসব কিছু নিয়ে সমাজের বিবেককে তিনি চাবুক দিয়ে কষাঘাত করেছিলেন। নারীর শিক্ষাগ্রহণ, নারীর বাইরে চলাফেরা এবং কাজের অধিকার, স্বাধীন চিন্তা-চেতনার অধিকার– এই বিষয়গুলো যে নারীর মুক্তির সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ, সেসব কথা বেগম রোকেয়া সারাজীবন বলে এসেছেন।’

নারীর এগিয়ে চলার জন্য শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং নারী-পুরুষের মধ্যে সমতার পক্ষে তিনি যুক্তি তুলে ধরেছেন তার লেখা ও কাজে। সমাজে নারীর অসম অবস্থানের কথা সবসময়ে ফুটে উঠেছে তার দৃপ্ত কলমে।

তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন নারী সমাজকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত রেখে দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নতি কখনই সম্ভবপর নয়। সারাজীবন তিনি পিছিয়ে থাকা নারী সমাজকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে অধিকার সচেতন করে তোলার প্রয়াস নিয়েছিলেন।

ড. সোনিয়া আনিম মনে করেন, ‘সারাজীবন নারী মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন বেগম রোকেয়া। তখন বাঙালির যে নবজাগরণ ঘটেছিল সেই প্রেক্ষাপটে বাংলার মুসলিম সমাজেও নবজাগরণের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিল। সেখানে বেগম রোকেয়ার মতো একজন মনীষীর প্রয়োজন ছিল বাঙালি নারীর নবজাগরণের পথ প্রশস্ত করার জন্য।’

১৯১৬ সালে তিনি মুসলিম নারীদের সংগঠন আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন।

রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে বেগম রোকেয়ার জন্মস্থানে ছড়িয়ে আছে বিশিষ্ট এই নারী শিক্ষাবিদের অবদানের স্মৃতিবহনকারী স্কুলসহ বহু প্রতিষ্ঠান।

বিবিসি বাংলাকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কেতকী কুশারী ডাইসন বলেন, ‘বাংলার নবজাগরণের মতো বড় একটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছিলেন বেগম রোকেয়া, কিন্তু নারী মুক্তির বাস্তব পথ দেখাতে তার অবদান ছিল বিশাল। মেয়েদের শিক্ষার জন্য তার সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠা, যেটা ছিল নারী শিক্ষার পথে একটা মস্ত বড় অবদান।’

শুধু শিক্ষাগত মুক্তি নয়, নারীর সার্বিক মুক্তির কথা চিন্তা করেছিলেন বেগম রোকেয়া।

নারী জাতি ও অর্থনৈতিক বিষয়ে তার এক প্রবন্ধে তিনি নারী-পুরুষের সমকক্ষতার যে আদর্শের কথা লিখে গেছেন তা আজকের দিনে নারী সমাজের জন্য একটা আদর্শ। তিনি জন্মেছিলেন সময়ের অনেক আগে।

এ বিষয়ে আয়েশা খানম বলেন, ‘রোকেয়ার অসামান্য একটা দূরদৃষ্টি ছিল। যার পরিচয় আমরা পাই তার ‘সুলতানার স্বপ্নে’ যেখানে তিনি বলেছিলেন- যাহা যাহা পুরুষ পারিবে, তাহাই নারী পারিবে। সেখানে ছিল একটা অসাধারণ স্বপ্ন যে নারীরা রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। তার লেখায় বর্ণিত রণকৌশল, রান্নার কৌশল, যানবাহন সবই সময়ের তুলনায় ছিল অনেক এগিয়ে।’

বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জীবনাবসান হয় ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর।

SHARE

About bnews24

Check Also

নেতৃত্বের উচ্চ পর্যায়ে থেকেও নারী বঞ্চনার শিকার : দীপু মনি

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, নতুন সমাজ গড়তে হলে অন্তর্ভুক্তিমূলক সংগঠন খুব জরুরি। স্বাধীনতার ৫২ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *